Page 1 of 20
দশম অধ্যায়-২
মীর আলী আশরাফের পুত্র মীর মোহাম্মদ আলীর ডাকনাম মীর খয়রাতী। তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইংরেজিতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ কেরন। নশরতশাহী ও নসিবশাহী পরগনা (পাংশা - বালিয়াকান্দি)জমিদারী ক্রয় করে প্রচুর অর্থবিত্তের অধিকারী হন। তিনি পদমদি ও মৃগীর নীলকুঠি ক্রয় করে নীলের ব্যবসায় প্রচুর লাভবান হন। পদমদিতে সুদৃশ্য দালানসহ মানুষের পানির অভাব দূর করতে বিরাট আকারের দিঘি খনন করেন। পদমদিতে পাঠশালা এবং কুষ্টিয়ায় একটি ইংলিশ স্কুল স্থাপন করেন। তিনি বেশিরভাগ সময় কলিকাতায় থাকতেন। কলিকাতায় মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশনসহ মোহামেডান ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড আমোদ প্রমোদ স্বভাবের। তিনি বিবাহ করেননি। বংশ মর্যদায় ছিলেন অহঙ্কারী। বৃটিশ সরকার তাঁকে ‘নবাব’ উপাধি প্রদান করে। ঊনিশ শতকের শেষার্ধে যখন তিনি নবাব উপাধিপ্রাপ্ত হন,
কলিকাতা থেকে পদমদি আসার পথে পাংশায় তাঁকে বিপুল মানুষের সমাবেশে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। পানশি নৌকা সাজিয়ে চন্দনা দিয়ে পদমদির পথে যাত্রা করেন। মীর মশাররফ হোসেনের কথায়-----
চন্দনার আনন্দ অপার
যেন হাসছে বারবার
বুকে করি নবাব তরী
যাচ্ছে অনিবা।
দুকূলে আকুল সবে
দেখবে নবাব সাধ মনে
তুমি ধন্য জগৎ মান্য
কে-তব জানে।
মীর মোহাম্মদ আলীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা মীর আবদুস সামাদ। তিনিও জমিদারী ক্রয় করেন। তিনি নসিবশাহী পরগনা (রাজবাড়ি সদর উপজেলা) জমিদারী ক্রয় করে ধন-সম্পত্তির মালিক হন। সাথে নীলের ব্যবসা। বিবাহ করেন বরিশালের বামনার জমিদার কন্যা ককরন সেনাকে। চার কন্যা। জ্যেষ্ঠ কন্যা আশরাফন নেসার বিবাহ হয় শায়েস্তাবাদের জমিদার মোহাম্মদ হোসেনের সাথে। মধ্যম নাম অজ্ঞাত, বিবাহ সৈয়দ শামসুল হুদা এমএবিএল হাইকোর্টের উকিল। বিবাহের পর কন্যার মৃত্যু। তৎকনিষ্ঠ আসমাতন নেসার সাথে শামসুল হুদার দ্বিতীয় বিবাহ। তৎকনিষ্ঠ আবেদন নেসার বিবাহ চরমদ্দির (বরিশাল) জমিদার চৌধুরী মোহাম্মদ ইসমাইল। মোহাম্মদ আলী ও আবদুস সামাদের একমাত্র বোন হায়াতুন নেসার বিবাহ হয় পদমদির অদূরে কুর্শীর জমিদার গোলাম কাদেরের সঙ্গে। গোলাম কাদেরের ভাই মকবুল আহমেদের দুই কন্যা আক্কি বিবি ও ওয়াজেদন নেসা। ওয়াজেদন নেসা বিদূষী মহিলা ছিলেন। তিনি তৎকালীন মুসলমান ছাত্রদের পড়ালেখার উন্নতির জন্য বহু সম্পত্তি দান করে যান।
পদমদির কুতুবুল্লার সন্তান মীর ওমর দারাজের বংশেই জন্মগ্রহণ করেন মীর মশাররফ। ওমর দারাজের পুত্র মীর এবরাহিম। মীর ওমর দারাজ বহু সম্পত্তির মালিক ছিলেন। জমিদার না হলেও চালচলন, বেশভূষা ছিল জমিদারদের মত। পুত্র মীর এবরাহিম ছিলেন তেজস্বী ও ডানপিটে। লেখাপড়ায় তেমন মন ছিল না। সারাদিন বর্শা হাতে চন্দনা নদীর তীরবর্তী জঙ্গলে বরাহ ও নানা বন্য পশু শিকার করে বেড়াতেন। একদিন বরাহ শিকার করতে যেয়ে আহত বরাহের আক্রমণে মরণ থেকে রক্ষা পান।
Page 2 of 20
এ কথা পিতার কর্ণগোচর হলে পিতা পুত্রের বধোদয়ে স্ত্রীকে এররাহিমের খাবার পাতে কিঞ্চিত ছাই রেখে দেওয়ার আদেশ দেন। স্মামীর আদেশ অমান্য করা মহাপাপ ভেবে স্নেহময়ী মা যথাজ্ঞা পালন করেন। মীর এবরাহিম পাতে ছাই দেখে অভিমানে গৃহত্যাগ করেন। তখনকার দিনে মুর্শিদাবাদ ছিল শিক্ষার কেন্দ্র। উদ্দেশ্য মুর্শিদবাদ যেয়ে লেখাপড়া শিখে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবেন। তখন হাঁটা পথেই ছিল একমাত্র অবলম্বন। মাঠ, ঘাট জঙ্গল পাড়ি দিয়ে গড়াই নদী পাড় হয়ে সাঁওতার ঘাটে যখন পৌঁছান তখন সন্ধায় হয় প্রায়। একতো রাত তারপর পথঘাট চেনেন না, পেটেও ক্ষুধা, নানা কথা ভাবতে থাকেন। ইতিমধ্যে জানতে পারেন সাঁওতায় আনার খাতুন নামে এক জমিদার আছেন যার বাড়িতে পথিক আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। তিনি আনার খাতুনের আশ্রয়ে রাত্রি যাপন করে সকালে বিদায় নেওয়ার সময় এলে আনার খাতুন তাকে ডেকে পাঠান। তিনি আনার খাতুনের নিকট সব বৃত্তান্ত বলেন। আনার খাতুন ওমর দারাজকে চিনলেন এবং বললেন সে তার জ্ঞাতি ভাই। যুবক ইবরাহিমকে যেতে দিলেন না। আনার খাতুনের স্বামী সন্তান ছিল না। তিনি পুত্রবৎ স্নেহে যুবক এবরাহিমকে পালন করেন এবং সময়ে সমুদয় জমিদারী লিখে দিয়ে পরলোকগমন করেন। সাত বছর পর মীর এবরাহিম পদমদি আসেন। হারানো পুত্রকে পেয়ে পিতা মাতার আনন্দের সীমা থাকে না। মীর এবরাহিম সাঁওতায় ফিরে যান। মীর এবরাহিমের পুত্র মীর জোলফেকার, মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ও কন্যা হাফিজা খাতুন ও নাসিমা খাতুন। মীর এবরাহিম দ্বিতীয় বিবাহ করেন পদমদির অদূরে দক্ষিণবাড়ির মলঙ্গ ফকীরের বিধবা কন্যাকে। দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান মীর সাহেব আলী ও এক কন্যা। এবরাহিম দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য সাঁওতার অদূরে লাহিনীপাড়ায় ভিন্ন বসতবাটি নির্মাণ করে দেন। পরে সাঁওতা থেকে পুরো পরিবার লাহিনীপাড়ায় উঠে আসে। মীর জোলফেকার আলীর পুত্র সন্তান ছিল না। দুই কন্যা ভরণ নেসা ও থরণ নেসা। মীর মোয়াজ্জেমের বিবাহ জেন্নাতুল্লাহর কন্যা দৌলতন নেসার সঙ্গে (১২৫৫)। গ্রাম কাশিমপুর, পরগনা বিরাহিমপুর। বিরাহিমপুর পরগনার মালিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর। (বিরাহিমপুর পরগনা থেকে ঠাকুর পরিবার বছরে ৩১/৩২ হাজার টাকা খাজনা পেতেন)। দৌলতন নেসার গর্ভে ১৮৪৭ সালে ১৩ নভেম্বর লাহিনীপাড়ায় মীর মশাররফ হোসেনের জন্ম। মীর জোলফেকার দ্বিতীয় বিবাহ করেন। দ্বিতীয় পক্ষের কন্যা শুকরণ নেসার সাথে ফরিদপুরের পার গেরদা গ্রামের গোলামাজমের বিবাহ। উল্লেখ্য তরফ সাঁওতার হিস্যা-অসিয়ত নামায় মীর জোলফেকার ও মীর মোয়াজ্জেমকে মীর এবরাহিম দান করেন। এছাড়া পদমদির বাটি, তালুক জমাজমি, পুস্করণী মীর মোয়াজ্জেমকে সমুদয় দানপত্র লিখে দেন। জামাই গোলামাজম মূল অসিয়তনামা জাতিয়াতী করে মোয়াজ্জেম হোসেনকে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে ফেলেন এবং মীর মোয়াজ্জেম প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব খুইয়ে ফেলেন। চার বছর বয়সে মশাররফের হাতেখড়ি দেন লাহিনীপাড়ায় মুন্সী জমির উদ্দিন। এরপর জগমোহন নন্দির পাঠশালায় ভর্তি। ১২ বছর বয়েসে পদমদি নবাবের স্কুলে ভর্তি। মাস্টার বাবু নবীনচন্দ্র্র মহিন্থা। স্কুলঘর আটচালা, পাকা গাঁথুনীর দেয়াল, খড়ের ছাউনি। পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য কৃষ্ণনগরে গমন। কৃষ্ণনগরে আই এ পড়ার কালীন নাদীর হোসেনের কন্যা আজিজন নেসার সাথে বিবাহ (নাদীর হোসেন তার সুন্দরী কন্যাকে দেখিয়ে বিবাহ দেন কুৎসিত কন্যা আজিজন নেসার সাথে)। মশাররফ প্রথমে পদমদি এস্টেটের ম্যানেজার। পরে টাঙ্গাইল দেলদুয়ারে করিমন নেসা এস্টেটের ম্যানেজার। দ্বিতীয় বিবাহ কুলসুম ডাকনাম কালী। শেষজীবনে মশাররফ পদমদিতে ফিরে আসেন। স্ত্রী বিবি কুলসুমের সাথে বসবাস করেন। পদমদিতে বিবি কুলসুম দেহত্যাগ করেন। মীরের কথায়------
তেরশত ষোল সাল ছাব্বিশে অঘ্রাণ
রবিবার প্রাতে প্রাণ করিল প্রয়াণ
পতিগত প্রাণধানি পতিসহ আসি
পদমদির মৃত্তিকায় রহিলেন মিশি।
ভাই ভগ্নি যেই হও ক্ষণিক দাঁড়াও
আত্মার কল্যাণে তার অশিষ দিয়ে যাও।
Page 3 of 20
বিবি কুলসুমের মৃত্যুর ২ বছর পর ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর মোশাররফ ইহলোক ত্যাগ করেন। দুটি মাজার পাশা-পাশি কালের স্বাক্ষী। স্মৃতি রক্ষার্থে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র। মনোরম পরিবেশে পল্লীর ছায়াঘেরা পদমদি বাংলার মানুষের এক শান্ত নিবাস।
ড. কাজী মোতাহার হোসেন
কাজী মোতাহার হোসেনের কন্যা সনজিদা খাতুন লিখিত ‘কাজী মোতাহার হোসেন’ পুস্তুকটির দুইপৃষ্ঠা উল্টাতেই বড় আকারের লেখা ------‘ডানা মেলে ওড়া’ পর্বে তিনি উল্লেখ করেছেন কাজী মোতাহার হোসেন স্বপ্নে হাত নেড়ে উড়ে কখনো আম গাছের উপরে কখনো বাঁশের ডগায় যেয়ে বসতেন। অনেকে বলে স্বপ্নে উড়া নাকি বদনসিবের লক্ষণ। কাজী মোতাহারের ক্ষেত্রে বদনসিবের কোনো লক্ষণ কখনো দেখা যায়নি। বরং যে স্বপ্ন তিনি লালন করতেন তাঁর সুদীর্ঘ জীবন প্রয়াসে সে স্বপ্নের সকল বাস্তবায়ন দেখতে পাই। তিনি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের আর্শীবাদপুষ্ট, জনমানুষের হৃদয়ের মণি, প্রাজ্ঞাজনের গুরু। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে আদর করে বলতেন-----‘আমার মোতিহার’।
কাজী মোতাহার হোসেনের জন্ম ৩০ জুলাই ১৮৯৭ সালে তৎকালীন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার অন্তর্গত কুমারখালি থানার লক্ষীপুর গ্রামে মাতুলালয়ে। তাঁর পিতার বাড়ি বর্তমান রাজবাড়ি জেলার পাংশা থানার বাহাদুরপুর গ্রামে। এ গ্রামের পূর্বের নাম ছিল বাগমারা। কাজী গওহর উদ্দিন ও তসিরণ নেসার চার ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে মোতাহার হোসেন ছিলেন সবার বড়। বাবা গওহর উদ্দিন প্রথমে সেটেলমেন্ট আমিন, পরে হেড আমিন এবং শেষে আমিনদের ইনসপেক্টর হয়েছিলেন। জরিপের কাজ সারা বছরব্যাপী হত না। ছয়মাস কাজ হত আর বাকি ছয়মাস তিনি বাড়িতেই থাকতেন। এই অবসরে তিনি বাড়ির পাঠশালায় শিক্ষকতা ও গ্রামের মসজিদে ইমামতি করতেন। তিনি ছিলেন সৎ নিষ্ঠাবান। তবে সংসার স্বচ্ছল ছিল না। চিরকাল তাঁকে দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছে। মোতাহার হোসেনের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়-----তিনি যখন যশ, খ্যাতি আর স্বচ্ছতার মধ্যে এসেছেন তখনও তিনি অতীত দিনের দারিদ্রের কথা ভোলেননি। আমি গরিবের ছেলে এ কথা বলতে তাঁর মনে কখনো দ্বিধা সংকোচ জাগেনি। তবে অর্থের দারিদ্রা থাকলেও পরিবারটির বিদ্যার দারিদ্র ছিল না।
কাজী মোতাহার হোসেন অত্যান্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। গ্রামের পাঠশালায় অধ্যায়নের পর তিনি সামান্য দূরের সেন গ্রামের উচ্চ প্রাইমারী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি সকল বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছিলেন। ১৭/১৮ বছর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯১৬ সালে পূর্ববাংলা আর আসামের মিলিত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে ১৫ টাকা বৃত্তি পান। তিনি প্রাইমারী পরীক্ষার পর কুষ্টিয়ায় লেখাপড়া করেন এবং কুষ্টিয়া থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। কলেজের পরিবেশ ভালো না লাগায় দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় রাজশাহী কলেজে চলে আসেন। ১৯১৭ সালে বিজ্ঞান শাখা থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে মাসিক কুড়ি টাকা বৃত্তিপ্রাপ্ত হন। এই বৃত্তিগুলোই তাঁর শিক্ষালাভকে নিশ্চিত করে। ১৯১৭ সালে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য ঢাকা আসেন। ঢাকা কলেজ তখন নামিদামী কলেজ। যার ঐতিহ্য আজও বিদ্যামান। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী এখানে বিএ, বিএসসি, এমএ, এমএসসি পড়ানো হত। ১৯১৯ সালে বিএ অনার্স পরীক্ষায় পূর্ববঙ্গ আর আসাম অঞ্চলে প্রথম হয়ে তিনি ৩০টাকা বৃত্তি পান। তখনকার দিনের ৩০ টাকা এখন প্রায় ১৫ হাজার টাকার সমান।
(তখনকার দিনে ১৫ টাকায় ১ ভরি সোনা পাওয়া যেত যার মূল্য বর্তমানে ২৪/২৫ হাজার টাকা) তিনি পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স আর সহযোগী বিষয়ে বিজ্ঞান পড়লেও আবশ্যিক বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়েছিলেন বলে ডিগ্রিটা বিএসসি না হয়ে বিএ হয়েছিল। তখন এরকম ব্যবস্থাই ছিল। বৃত্তির টাকাটা তিনি নিজে খরচ করতেন না। গ্রামে তখন তার বাবা অসুস্থ। তাই টাকাটা বাবাকে পাঠিয়ে দিতেন। ছুটির সময়ে বৃত্তি পাওয়া যেত না তখনকার দিনে। তাই বাড়িতে টাকা পাঠানোর জন্য স্কুলে শিক্ষাকতার কাজ নিতে হত তাঁকে।
Page 4 of 20
১৯১৯ সালে একবার দৌলতপুর মোহসীন স্কুলে ৫০ টাকা বেতনের চাকরি নিয়েছিলেন। ১৯২১ ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মোতাহার হোসেনের পরীক্ষার ফল বের হয়নি। এ সময়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ডেমোনেস্টেটর হিসাবে যোগ দেন। ফল বের হলে তিনি প্রভাষক পদ লাভ করেন। ১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে সহকারী প্রভাষকের পদ লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে এমএ পাশ করেন। পদার্থ বিজ্ঞান, গণিত ও পরিসংখ্যান এই তিন বিভাগেই তিনি শিক্ষাকতা করেন। পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে সান্নিধ্য লাভ করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর। তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বের বোসন পার্টিক্যাল বা বোস তত্বের আবিস্কার কর্তা। পরিসংখ্যানবিদ্যা শিখতে গিয়ে তিনি প্রফেসর প্রশান্ত চন্দ্র মহলনিবিশের স্নেহ ও সান্নিধ্য লাভ করেন। পরিসংখ্যান আজ শিক্ষার প্রায় সকল স্তরে পঠন পাঠনের ব্যবহারের পৃথিকৃৎ কাজী মোতাহার হোসেন।
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগ পুনর্বিন্যস্ত হয়ে গণিত ও পরিসংখ্যান বিভাগ গঠিত হলে এর রিডার ও বিভাগীয় প্রধানের পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৯৫০ সালে ডিজাইন অব এক্রিপেরিমেন্টাল বিষয়ে গবেষণা করে তিনি পিএইচডি (১৯৫০) ডিগ্রি লাভ করেন। এই অভিসন্দর্ভের অন্যতম পরীক্ষক স্যার রোনান্ড ফিসার তাঁর গবেশণা কাজের বিশেষ প্রশংসা করেন। এই অভিসন্দর্ভতে তৎকর্তৃক গবেষণা কর্মে এক নতুন পদ্ধতির নির্দেশনা আসে যা ‘হুসেনস চেইন রুল’ নামে অভিহিত। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। পূর্ববাংলায় তথ্যগণিতের বা সংখ্যা তত্ত্বের চর্চা শুরু হয়। তথ্য গণিত নামটি কাজী সাহেবের নিজের দেওয়া। এদেশের তথ্য গণিতের তিনিই পিতা। ১৯৫৬ সালে তিনি পরিসংখ্যান বিভাগের প্রফেসর পদে উন্নিত হন। ১৯৬১ তে নিয়মিত অধ্যাপনার কর্ম থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই বছর পরিসংখ্যান বিভাগের সুপার নিউমাবি অধ্যাপক পদে রত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউট অব স্টাটিসটিক্যাল রির্সাস এন্ড ট্রেনিং এর পরিচালক (১৯৬৪-১৯৬৬) নিযুক্ত হন। ১৯৬৯ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এমেরিট্যাস প্রফেসর পদের সম্মান লাভ করেন। প্রবন্ধ সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরুস্কার লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ সম্মান জানাবার জন্য তাঁকে ডক্টর অব সায়েন্স বা ডিএসসি ডিগ্রী দেন। ১৯৭৫ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক মর্যাদায় ভূষিত হন।
শিক্ষক, গণিতজ্ঞ, পথনির্দেশক, দাবাগুরু এতসবের পরেও তার বড় পরিচয় তিনি সাহিত্যিক ও সমাজের পথ নির্দেশক। ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্যে তাঁর অনুরাগ ছিল। সাহিত্যে হাতেখড়ি কুষ্টিয়া হাইস্কুলের পড়ার সময়ে ‘দামোদরের কন্যা’ বিষয়ে একটি রচনা লেখেন। ‘গ্যালিলিও’ তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। এটা সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি যখন বিএ ক্লাসের ছাত্র তখন তাঁর লেখা ‘সুন্দর’ নামে একটি প্রবন্ধ ঢাকা কলেজ বার্ষিকীতে ছাপা হয়। এরপর তিনি লিখতে থাকেন। লেখালেখির প্রাথমিক অবস্থায় গল্প ও কবিতার প্রতি ঝোঁক ছিল। সে পথে না যেয়ে তিনি পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন সামাজিক প্রবন্ধ রচনায়। এর উদ্দেশ্য ছিল আমরা কোথায় আছি তা বোঝাবার চেষ্টা এবং পাশাপাশি পথ নির্দেশের ইঙ্গিত। জাতি ধর্ম নির্বিশেষ সকলকে সমাজ বিকাশের নিত্য নতুন ধ্যান-ধারণা আত্মস্থ করতে হয়। তা না হলে জাতি ভ্রম ও বিচ্যুতির আবর্তে নিপতিত হয়। এসব ক্ষেত্রে প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, চিন্তক পথ নির্দেশের ইঙ্গিত দেন। কেবল আত্মপ্রত্যয়ের আনন্দ নয় লেখকের যে একটা সামাজিক দায়িত্ব আছে যা থাকতে হয় প্রতিকূল সময় ও পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়েও লেখক জীবনের সূচনাপর্বে তিনি এই সত্যটিকে আত্মস্থ করেই দৃঢ় প্রত্যয়ে কলম ধরেছিলেন। এক ভিন্ন উপলব্ধিতে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বলেছেন-------
‘আমার চিন্তা, কর্ম এবং লেখা জীবনের একটা অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। এতে সফলতা যতটা না হোক একটা আদর্শ অনুসরণের সহজ আনন্দ যেন পেতে লাগতাম। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা অল্প আশা রইল যে আজকের ক্ষীণ আলো ভবিষ্যতে শক্তি সঞ্চয় করে যখন প্রখর পূর্যে পরিণত হবে তখন আর তাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারো থাকবেন। (লেখক হওয়ার পথে-সঞ্চরণ)। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ সঙ্কলন সঞ্চরণ রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীর বিশেষ প্রশংসা পায়। শরৎচন্দ্র, মোহিতলাল মজুমদার, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায়, কাজী আবদুল ওদুদ এঁরাও মোতাহার হোসেনের লেখার অনুরাগী ছিলেন। সঞ্চারণ প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথ অভিমত ব্যক্ত করে লেখেন যে-------
Page 5 of 20
আপনি বিচিত্রভাবে এবং আলোচনার বিষয়কে স্বচ্ছ প্রাঞ্জল ভাষার রুপ দিয়ে যে প্রবন্ধগুলো আপনার সঞ্চরণ গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন তা পড়ে পরিতৃপ্ত হয়েছি। আপনার বলবার সাহস এবং চিন্তার স্বকীয়তা সাধুবাদের যোগ্য। সাহিত্য পথে আপনার অধ্যাবসায় জয়যুক্ত হোক এই কামনা করি।
কাজী মোতাহার হোসেন মূলত মৌলিক চিন্তাশ্রয়ী প্রাবন্ধিক হিসেবেই পরিচিত। চিন্তার মৌলিকত্ব, বক্তব্যের ঋজুতা ও প্রকাশভঙ্গীর প্রাঞ্জলতা তাঁকে এক ব্যতিক্রমী মননশীল সাহিত্য শিল্পীর মর্যাদা দান করেছে। তাঁর সমাজ ও সংস্কৃতিক বিজ্ঞান ও ধর্ম সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের বেশ কয়েকটি শিখা পত্রিকা ও মুসলিম সাহিত্য সমাজ এর সাহিত্য বাসরের জন্য রচিত হয়েছিল।
নজরুল চর্চার সেই প্রথম পর্বেই প্রকাশিত হয় মোতাহার হোসেনের লেখা ‘নজরুল কাব্য পরিচিত’ (১৯৬৫)। এর পূর্বে ১৯৫১ তে প্রকাশিত হয় ‘সেই পথ লক্ষ্য করে’। প্লেটোর ‘সিম্পোজিয়াম’ অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ তে। কাজী আশরাফ মাহমুদের বেশ কয়েকটি হিন্দি কবিতার বই এবং হযরত দাতা গঞ্জাবক্সের জীবনী ১৯৬৮ তে প্রকাশিত হয়। এছাড়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বেশ কিছু পাঠ্যপুস্তক তিনি রচনা করেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য তথ্য-গণিত (১৯৬৯), গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস (১৯৭০), আলোক বিজ্ঞান (প্রথম ১৯৭৫)। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান পঠন পাঠনের তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সমর্থক। এ বিষয়ে প্রফেসর সত্যেন বসু ছিলেন তার আদর্শ ও অনুপ্রেরণা। মূলত প্রাবন্ধিক ও সমালোচক হলেও মোতাহার হোসেন কিছু কবিতা রচনা করেছেন। আব্দুল হক ও আবুল আহসান চৌধুরীর সম্পাদনায় বাংলা একাডেমী থেকে চার খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনাবলী। এর বাইরে ও তাঁর বেশ কিছু ইংরেজি বাংলা রচনা অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। ধর্ম, সমাজ, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক বহু প্রবন্ধ রচনায় সুস্থ মনন ও পরিচ্ছন্ন জীবনবোধের পরিচয় উৎপন্ন হয়েছে। ‘অসীমের সন্ধানে’এ প্রবন্ধটি আমাদের সময়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যসূচিতে ছিল। প্রবন্ধটি একাগ্রতার সাথে পাঠ করে মহাকাশকে নিয়ে আমার মধ্যে যে কৌতুহল জেগেছিল তারই ফলশ্রুতিতে হয়ত আমি আজ রচনা করতে পেরেছি ‘মহাবিশ্বের স্বরুপ শুরু ও শেষ’, ‘সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনে বিজ্ঞান’ ইত্যাদি গ্রন্থসমূহ।
মুসলমানদের উদারনৈতিক চেতনার অভাবে তারা শিল্প ও সাহিত্য চর্চায় পিছিয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে আধুনিক ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা চেতনায় আড়ষ্টতা দেখা দেয়। ১৯২৬ সালে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ নামে প্রগতিশীল সাহিত্য সংগঠন গড়ে ওঠে কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ ও আবুল হুসেনের প্রচেষ্টা ও প্রেরণায়। বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীনচর্চা ও বুদ্ধির মুক্তি ছিল তাদের কাম্য ও লক্ষ্য। শিখাগোষ্ঠী নামে এই দলের মূল বক্তব্য ছিল-----‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ আবদুল ওদুদকে বলা হত শিখা সমাজের মুস্তস্ক, আব্দুল হুসেনকে অঙ্গ-প্রতঙ্গ মোতাহার হোসেনকে এর হৃদয়। এই মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক মুখপত্র শিখার দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের সম্পাদক ছিলেন মোতাহার হোসেন। এই আন্দোলনের প্রসঙ্গ ও পরিণতি নিয়ে মোতাহার হোসেন তার এক মূল্যায়নে বলেছেন-----
‘যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এক গোঁড়া শাস্ত্রাচারে আবদ্ধ প্রগতিবিমুখ সমাজের সঙ্গে লড়েছিলাম, তা যে অনেকখানি সার্থক হয়েছে আজকের প্রগতিশীল বাংলাদেশের সমাজ দেখে তা বোঝা যায়।’ সাহিত্য সংস্কৃতির সূত্র ধরে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। সখ্যতা ধীরে ধীরে সৌহার্দ এবং শেষে পরম আত্মীয়ের পর্যায়ে পৌঁছে। নজরুলের ঢাকাবাসের দিনগুলো কাটে মোতাহার হোসেনের বাসায়। কবি তাকে সম্মোধন করে ডাকতেন আমার মোতিহার (মূল্যবান মোতি দ্বারা কণ্ঠহার)। নজরুল ঢাকায় যে বিদুষী ফজিলাতুনন্নেসার সঙ্গে প্রণয় সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন তারও মাধ্যম ছিলেন মোতাহার হোসেন। তাঁকে লেখা নজরুলের চিঠিপত্রে এবং মোতাহার হোসেনের স্মৃতি কথায় উভয়ের গাঢ় সম্পর্কের পরিচয় মেলে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্রপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর ছিল বিশেষ ঘনিষ্ঠতা। দাবা খেলার সূত্রে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা জন্মালেও সাহিত্য আলোচনাতেও তা প্রসারিত হয়েছিল। আবুল আহসান চৌধুরীর ভাষায়-----‘শরৎ সাহিত্যে মুসলিম চরিত্র চিত্রণ বিশেষ করে তাঁর মহেশ গল্পটি মোতাহার হোসেন এর সঙ্গে আলাপচারিতার ফসল।’ আজকের দিনে মুসলমান সমাজে নারী পুরুষের গান-বাজনা, খেলাধুলা, ভ্রমণ ইত্যাদিতে বাধা নেই। কিন্তু মোতাহার হোসেন এর কালে মুসলমান সমাজে এরুপ আনন্দ কোলাহল হাসি খুশীর অভাব ছিল। নন্দ ও মুসলমানগৃহ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-------
Page 6 of 20
পাতার নিচে কী সুন্দর মর্মর শব্দ হয়। ভোরবেলা পাখির গানে আনন্দের সুর। আর আমরা পৃথিবীর সেরা জীব হয়ে জীবনের ভিতরে আনন্দের ছন্দ তৈরি করতে পারি না কেন? প্রাণ খুলে আনন্দ করতে পারলেই সমাজ প্রাণময় হয়, গৃহে আনন্দের ফোয়ারা ছোটে আর মন সবল ও সচেতন হয়। বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই মিলে খোলামেলা আলাপ করতে পারলে জীবন সহজ হয়। কিন্তু মুসলমান ঘরের হালচাল কী? বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই মিলে মুসলমান আনন্দ করবে না, ছবি আঁকবে না। মুসলমান পুরুষেরা কেবল কাজ করবে মেয়রা কেবল রাঁধবে বাড়বে, মুসলমান বাপের সামনে হাসবেন না বড় ভাইয়ের সঙ্গে খেলবেন না, গুরুজনের অন্যায় কথার প্রতিবাদ করবেন না এমন কি কচি ছেলেরা মার খেলেও চেঁচিয়ে কাঁদবেন না।
সেকালের অবস্থা এমনই ছিল। মোতাহার হোসেন ব্যক্তিগত জীবনে এ অচলায়তন ভেঙ্গেছেন। তার পারিবারিক জীবনে উদার নৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটেছিল। তিনি এদেশে দাবা খেলার পথিকৃৎ। দাবা খেলায় তিনি অনেক প্রশসংসা পেয়েছেন। চিঠি লিখে ভারতবর্ষের খেলোয়াড়দের সঙ্গে দাবা খেলতেন। একে বলে করেসপন্ডেস চেস। দক্ষিণ আফ্রিকান করেসপন্ডেস চেস চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯২৫ সালে কলিকাতা জাতীয় দাবা খেলাতেও তিনি চ্যাম্পিয়ন হন। সমগ্র ভারতবর্ষে তিনি ৭ বার চ্যাম্পিয়ন হন। তিনি বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন গড়ে তোলেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি দাবা ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশের দাবার ক্ষেত্রে তিনি দাবা গুরু বলে পরিচিত হন। বাংলাদেশে প্রতিবছর কিউএম হোসেন দাবা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এদেশে রানী হামিদ, গ্রান্ড মাস্টার নিয়াজ মোরশেদ খুব পরিচিত নাম। বাংলাদেশে দাবা আন্তর্জাতিক সুনাম বয়ে এনেছে। নিয়াজ মোরশেদের মেধা অনেক আগেই কাজী সাহেব সনাক্ত করেছিলেন। দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি বরাবরই যুক্ত ছিলেন। সকল প্রকার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনাচার, অন্যায়, অন্যায় বিচার, সাম্প্রদায়িকতা, রক্ষণশীলতা, প্রতিক্রীয়াশীলতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। কোনো ভয়ভীতি, প্রলোভন তাঁকে নিবৃত করতে পারে নাই। রাষ্ট্রভাষা, ভাষা সংস্কার, হরফ পরিবর্তন, রবীন্দ্র বিরোধিতা, সংবাদপত্র সংকোচন এসকল বিষয়ে সঠিক বক্তব্য রাখতে কখনো তিনি দ্বিধান্বিত হন নাই। রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে তার মতামত ছিল সরল ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একমাস পরেই তিনি রাষ্ট্রভাষা ও পূর্বপাকিস্তানের ভাষা সমস্যা প্রবন্ধে লেখেন------
পূর্ব পাকিস্তানের রাজভাষা ও রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়াতে স্বাভাবিক ও সমীচীন কোনো কোনো পরমুখাপেক্ষী বাঙালীর মুখে ইতিমধ্যেই উর্দুর ঝনাৎকার শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এদের বিচার বুদ্ধিকে প্রশংসা করা যায় না। এসকল উক্তি কলের মানুষের অপুষ্ট মনেরই অভিব্যক্তি। এতে বাঙালির জাতীয় মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে, তার ফলে এই দাঁড়াবে যে বাঙালি হিন্দু মুসলমান ইংরেজ রাজের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে অমনি পাঞ্জাব সিন্ধু বেলবী রাজের কবলে পড়বে।’ ঐ একই প্রবন্ধে উর্দুভাষীদের সতর্ক করে দেন এই বলে------বর্তমানে যদি গায়ের জোড়ে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষা রুপে চালাবার চেষ্টা করা হয় তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধুমায়িত অসসন্তোষ বেশিদিন চাপা থাকতে পারে না। শিঘ্রই তাহলে পূর্ব পশ্চিমের সীমান্তের অবসান আশঙ্কা আছে। মোতাহার হোসেনের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এসব মতামতই ইতিহাসের পথ বেয়ে বাস্তবে রুপ নেয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফলে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের থেকে পূর্ববাংলার যে চির বিচ্ছেদ ঘটে তার মূলের দিকে লক্ষ্য করলে ভাষা নিয়ে দ্বন্দ্ব, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে সে সময় যে অধ্যাপক সমিতি গঠিত হয় তার সভাপতি থাকেন কাজী মোতাহার হোসেন। ভাষা সংস্কার প্রশ্নেও তাঁর ভূমিকা ছিল স্পষ্ট, দৃঢ় ও যুক্তিপূর্ণ। বাংলা ভাষা ও সমস্যা প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-----
পণ্ডিতদেরই হোক, সমাজ পতিদেরই হোক অথবা রাজনীতিবিদদেরই হোক কারো নির্দেশমত ভাষার কোনো স্থায়ী সংশোধন বা সমৃদ্ধি লাভ হয় না বা হবে না। এরুপ অবাঞ্চিত ও আত্মঘাতি হস্তক্ষেপের ফলে দেশবাসীর চিন্তাশক্তিতে বাধা পড়বে। ভাবে স্বাধীনতা ব্যবহৃত হবে। ভাষার স্বাচ্ছন্দ জনিত আনন্দের অভাব হবে। ১৯৫৩ সালের ২৭-২৮ ফেব্রয়ারি ও ফেব্রয়ারি ও ১ মার্চ শান্তি নিকেতনে অনুষ্ঠিত সাহিত্য মেলায় মোতাহার হোসেন পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। এই মেলায় তার উদার ও মুক্তমনের বক্তব্য পশ্চিমবেঙ্গর সুধী সমাজ ও পত্র পত্রিকায় বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এ প্রসঙ্গে কলিকাতার প্রগতিশীল সাহিত্যপত্র নতুন সাহিত্য এর প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল।
Page 7 of 20
মোতাহার হোসেন অনেক সরল পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্যের মধ্যে একটা মূল কথা ঘোষণা করে গেলেন। যেটা মনে থাকবে সকলের। তার বক্তব্যে হুঁশিয়ারী ছিল সাহিত্যে হিন্দুকরণ বা ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে। তিনি বললেন----‘জলকে পানি বলে উল্লেখ করলে সাহিত্যের জাত যাবে না। জাত যাবে যদি জলচৌকিকে পানিচৌকি, পানি পথকে জলপথ, জলযোগকে পানিযোগ, জলপানিকে পানিপানি বা পানিপানিকে জলপানি করা হয়।’ মোতহার হোসেন কেবল ভাষার ক্ষেত্রেই নয় ১৯৬১ সালে প্রতিকূল পরিবেশের মধেও তিনি রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী পালনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৭ সালের বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধন্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৭১ সালের মার্চে বিভিন্ন সভা সমিতিতে তিনি বাঙালি জাতির স্বাধীকার সংগ্রামের স্বপক্ষে বক্তব্য পেশ করেন।
ধর্মের পরিচিতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটলেও পূর্বপাকিস্তানি মুসলমানদের মধ্যে আবহমানকাল ধরে বাঙালি সংস্কৃতির ধারা প্রবাহমান। কেবল ধর্মের গণ্ডীর মধ্যে তাদের আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয় এ বিষয়টি মোতাহার হোসেন বিশেষভাবে অনুভব করতেন। প্রগতিশীল সাহিত্য সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভাপতি হিসেবেও তিনি বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন। এই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ১ লা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণার দাবি জানিয়ে ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে বিবৃতি দেন। এই সংগঠনের উদ্যোগে ও মোতাহার হোসেন এর সভাপতিত্বে ঢাকায় প্রথমবারের মতো ম্যাক্সিম গোর্কির মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির উপর যখনি কোনো হামলা এসেছে তিনি তখনি তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। প্রগতি ও বাঙালি সংস্কৃতির স্বপক্ষে তিনি আজীবন ভূমিকা পালন করে গেছেন। এসব কারণে পাকিস্তান আমলে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁকে সরকারের বিরাগভাজন হতে হয়।
পৃথিবীর জ্ঞানী মানুষের বিচিত্র আচরণ লক্ষ্য করা যায় নিউটন, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথসহ অনেক দার্শনিক পণ্ডিতের অদ্ভুত আচরণের অনেক গল্প প্রচলিত আছে। মোতাহার হোসেনের কিছু অদ্ভুত ধরনের গল্প আছে, যেমন----মোতাহার হোসেন ইউনিভার্সিটিতে তার কন্যা সানজিদা খাতুনের সামনাসামনি পড়ে গেলে তাকে বিনীতভাবে সালাম দিতেন। কন্যা বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে নালিশ করল যে বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সাথে দেখা হলে হাত তুলে সালাম দেয়। স্ত্রী স্বামীকে বকা দিয়ে বললেন নিজের মেয়েকে কি কেউ সালাম করে? উত্তরে মোতাহার হোসেন বলেছিলেন কী করবো চেনা-চেনা মনে হল তাই। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের একটি লেখা থেকে জানা যায়। ড. মোতাহার হোসেন একবার চাকরি থেকে ফিরে এসে তিনি সেগুন বাগিচার তার নিজের বাসা হারিয়ে ফেলেন। তারপর পথচারিকে জিজ্ঞাসা করেন ভাই ড. মোতাহার হোসেন এর বাসা কোনোটা? ১৯২০ সালে ছাত্র অবস্থায় থাকাকালীন হুগলীর মেয়ে কলকাতাবাসী সাজেদার সঙ্গে মোতাহার হোসেন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী সাজেদার বাসায় উর্দু চল ছিল বাংলার চেয়ে বেশি। খুলনার মেয়ে মোসলেমার প্রভাবে সাজেদা বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারানী ও যুগলঙ্গুরীয় এই দুই উপন্যাসে উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর সাত মেয়ে ও চার ছেলের মধ্যে দুই ছেলে স্কুলজীবনেই মারা যায়। মেয়েদের মধ্যে যোবায়দা কর্মজীবনে ইংরেজির অধ্যাপিকা ছিলেন। মেঝ-কন্যা ওবায়েদা সরকারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। অন্য মেয়েদের মধ্যে সানজিদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রফেসর। তিনি রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও বরীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে পরিচিত। আর এক মেয়ে ফাহমিদা খাতুন ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা এবং উঁচুমানের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। ছোট মেয়ে মাহমুদা চিত্রশিল্পী ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। ছেলে কাজী আনোয়ার হোসেন মাসুদ রানা সিরিজের লেখক এবং রহস্যপত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। ছোট ভাই কাজী মহাবুব হোসেনও ইংরেজি এ্যাডভেঞ্চারের অনুবাদক হিসেবে পরিচিত। কাজী আনোয়ারের সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁদের বই প্রকাশিত হয়।
রাজবাড়ি জেলার মাটিতে জন্ম নেওয়া ড. কাজী মোতাহার হোসেন দেশ ও জাতির জন্য যে অবদান রেখে গেছে সে কারণে তিনি সকলের কাছে প্রাতঃস্মরণীয়। নিরহঙ্কার, আপনভোলা, বিদ্বান ও গুণী এ মন্তব্য ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর। অন্নদাশঙ্কর রায়ের পর্যবেক্ষণে, ‘বরাবরই তিনি একজন উদারমনা মুসলমান ও সেই সঙ্গে দেশপ্রাণ বাঙালি এবং সকলের উপর একজন সৎ মানুষ।’
Page 8 of 20
শান্ত স্বভাব ও সৌম্যদর্শন এ মনীষী জ্ঞানচর্চাতেই জীবন কাটিয়েছেন। মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিপন্থায় নিবেদিত ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে নিষ্ঠাবান ধর্মচারী। রোজা, নামাজ, হজ্ব পালনে শৈথিল্য ছিল না। আবুল আহসান চৌধুরীর ভাষায়------‘মোতাহার হোসেন এর জীবন থেকে খুব প্রাসঙ্গিক খুব জরুরি একটা শিক্ষা পাই যে, প্রকৃত ধর্মচর্চার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ এই মনীষী ১৯৮১ সালে ৯ অক্টোবর পবিত্র ঈদুল আজাহার দিনে ৮৫ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন আজকের দিনে জাতি তমসা কাটিয়ে সুষ্ঠু জ্ঞানচর্চায় অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। শিল্প সাহিত্য অর্থনীতি, সমাজনীতি সকল ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ উন্নতির স্বাক্ষর রেখে চলেছে। অনেক সাধকের ভিড়ে শান্তশিষ্ঠ শ্মশ্রুমণ্ডিত আমাদের মোতাহার হোসেন উজ্জ্বল মুখটির হাঁসির আভায় আমরা প্রতিনিয়ত স্নাত হব। কুসংস্কার, রক্ষণশীলতা অমঙ্গল এবং সকল পশ্চাৎপদতা পিছনে রেখে তাঁর আদর্শে সদা অনুপ্রাণিত হয়ে উঠব।
কাজী আব্দুল ওদুদ
সমাজ, সাহিত্য, চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে কাজী আব্দুল ওদুদের অসামান্য অবদানের পূর্বে তাঁর পরিচয়টুকু গ্রহণ করা যাক। ১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলার মাগমারা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম কাজী সগীরউদ্দিন। কাজী সগীরুদ্দিন ছিলেন রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার। ১৯১৩ সালে কাজী আব্দুল ওদুদ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯১৫ ও ১৯১৭ তে কলিকাতা প্রেসিডিন্সী কলেজ থেকে যথাক্রমে আইন ও বিত্র পাশ করেন। ১৯১৯ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন।
প্রেসিডেন্সী কলেজে ছাত্রকালীনে তিনি মাতুল কন্যা জমিলা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯২০ তে ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজে বাংলার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর কলিকাতায় বদলি হন এবং সেখানে শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টরের অধীনে টেক্সট বুকস কমিটির সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। এই পদ থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে নবপর্যায়ে প্রকাশিত তরুণ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯২৬ খ্রি. ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম সাহিত্য সমাজ। তিনি ছিলেন সমিতির অন্যতম স্তম্ভ ও নেতা। সাহিত্য সমাজের পত্রিকা ‘শিখায়’ (১৯২৭) মুক্তচিন্তা ও যুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন লেখার জন্য নওয়াব পরিবার কর্তৃক নিগৃহীত হয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং কলিকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন (১৯৪০’রপর)। ন্যায়নিষ্ঠা উদার ও দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য তিনি খ্যাত। তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসা সমিতির প্রধান উদ্যোক্তা এবং কবির চিকিৎসার জন্য অর্থসংগ্রহসহ চিকিৎসার কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯ মে ১৯৭০ কলিকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
কাজী আব্দুল ওদুদ শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমাজসচেতক, সাংবাদিক এবং সর্বোপরি মুসলীম সমাজের নবচেতনার উম্মোচনকারী বলা যায়। মুসলমান সাহিত্যিক হিসেবে মীর মশাররফ হোসেনের অনেক পরে তাঁর আবির্ভাব তবে কায়কোবাদ, মোজাম্মেল হক, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কাজী ইমদাদুল হক, এস ওয়াজেদ আলীর উত্তরসূরী কাজী আব্দুল ওদুদ। তাঁর রচিত উপন্যাস ‘নদীবক্ষে’ (১৯১৮), ‘মীর পরিবার’(গল্প) (১৯১৮), ‘রবীন্দ্রকাব্যপাঠ’ (১৩৩৪), ‘হিন্দু মুসলমানের বিরোধ’ (১৯৩৬, ‘কবিগুরু গ্যাটে’ দুইখণ্ডে সমাপ্তি (১ম খণ্ড ১৩৬৯ ও দ্বিতীয় খণ্ড ১৩৭৬), ‘সমাজ ও সাহিত্য’ (১৯৩৪) ‘শাশ্বত বঙ্গ’ (১৯১৫), ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ’ (প্রথম খণ্ড ১৩৬৯, ২য় খণ্ড-১৩৭৬), ‘নজরুল প্রতিভা’ (১৯৪৮), ‘পথ ও বিপথ’ ১৩৪৬), ‘মানব বন্ধন’ (১৩৪৮), ‘আজাদ’ (উপন্যাস ১৯৪৮) ‘তরুণ ভুল ও মা’ (ছোট গল্প ১৩৫৫), ১৯৫৬ তে বিশ্বভারতীতে প্রদত্ত বক্তৃতাবলী ‘বাংলার জাগরণ’ নামে গ্রন্থিত হয়ে ঐ বছরেই প্রকাশ, শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় উপর ১৯৫৭ তে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতা শরৎচন্দ্র ও তারপর ১৯৬১ তে পুস্তকাকারে প্রকাশিত।
Page 9 of 20
হযরত মুহম্মদ ও ইসলাম (১৩৭৩) এবং জীবনের শেষ পর্বে কোরানের সুললতি ও প্রাঞ্জল বঙ্গানুবাদ। তাঁর সম্পাদিত ব্যবহারিক শব্দকোষ একখানি জনপ্রিয় বাংলা অভিধান। সাহিত্যচর্চায় কাজী আব্দুল ওদুদের আবির্ভাব তখন, যখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পরিপূর্ণ আধুনিক হয়ে উঠেছে। ভাষা ব্যবহারে কেতাবী ভাষার পরিবর্তন এসেছে। অফিসের ভাষা, লেখার ভাষা-মুখের ভাষার মতো সহজ হয়ে উঠেছে। এমন কি সাবেকি সাধু ভাষার পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যবহার হচ্ছে চলিত ভাষা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেবদেবী তো নয়ই এবং চরিত্রগুলো চারপাশের দৈনিন্দিন যাপনকারী মানুষের জীবনচরিত্র। এছাড়াও সাহিত্য এসেছে মানবমানবীর প্রেম, এসেছে প্রকৃতি, সমাজ, রাজনীতি। তাই বিশ শতকের সাহিত্য আধুনিকতায় উদ্ভাসিত সাহিত্য বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন। বিশ শতকের সাহিত্যের অন্য আর একটি বিশেষত্ব হল এখানে কল্পনার সাথে বাস্তবায়নের প্রয়াস আছে। সহজ কথায় সাহিত্যে সৃষ্টিশীল হয়ে উঠেছে। ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিকতায় রবীন্দ্রনাথের অবদান অসামন্য। কস্তুত তিনি বাংলা সাহিত্যের ভাবমূর্তি বদলে দেন। তার সাহিত্য জীবনের অর্ধেক কাজ উনিশ শতকে আর অর্ধেক কাজ বিশ শতকে। এ সময়ের মধ্যে সাহিত্যের প্রতিটি শাখাকেই তিনি সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁর কবিতা অনন্য সাধারণ। প্রকৃতি আর আধ্যাত্বিকতার সমন্বয়ে কবিতা মানবচেতনার বিচিত্র মাত্রা সংযোজিত করে। যে কথাসাহিত্য দিযে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনা বিশ শতকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এসেছিলেন চোখের বালির মতো উপন্যাস লিখে। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের চেয়ে আরো সূক্ষ্ণভাবে মানবাচরণ অঙ্কন করতে পেরেছিলেন। তবে তিনি একাই নন আরো বহু সাহিত্যিক এগিয়ে এসেছিলেন সাহিত্যকে নানা ডালপালা; ফুলে ফলে সাজাতে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আত্মপ্রত্যয়ী করেছিল। নানা ঢঙ্গে ও ভঙ্গিতে অজস্র সাহিত্য চর্চা হতে থাকল। শরৎচন্দ্র চট্রপাধ্যায়, বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্ত, কাজী আব্দুল ওদুদ সাহিত্যক গ্রামজীবন ও সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে এলেন। সাহিত্য বিষয়ে এয়াকুব আলী চৌধুরীর বর্ণনা ও ব্যাখ্যা প্রনিধানযোগ্য। সাহিত্যসেবা প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন------
সাহিত্যিক প্রকৃতির কুম্ভকার, তিনি কুম্ভ বিক্রয় করেন না, কুম্ভ নির্মাণ করেন। প্রকৃতির বুকে যে সুষমা আছে, মনোভাবের যে রাগিনী আছে, মানব জীবনের সত্যের যে বিচিত্র বিকাশ আছে, সমুদয় পার্থিব ও চিন্তালেশ শূন্য নির্মল নির্দোষ ক্রীড়ারত হাস্যময় বালকের নাচিয়া বিচিত্র পক্ষ প্রজাপতি ধারার মতো সেই সমস্ত নানা বর্ণের ভাব চিন্তা ও সত্য ধরিয়া তাহার মূর্তি প্রদান করাই তা
কাজী আব্দুল ওদুদের প্রথম উপন্যাস ‘নদীবক্ষে’ ১৯১৯ সালে তাঁর ছাত্রজীবনে প্রকাশিত হয়। অপর উপন্যাস ‘আজাদ’ লেখা হয় ১৯৩০ এর দিকে। উপন্যাসই তাঁর যৌবনকালের রচনা। বাঙালি মুসলমান সমাজকে অবলম্বন করে উপন্যাস দুটি গড়ে উঠেছে। ‘নদীবক্ষে’ বাঙালি মুসলমান কৃষক জীবনের কাহিনী এবং ‘আজাদ’ শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান সমাজের জীবন চিত্রের রুপায়ন। নদীবক্ষের পটভূমি রাজবাড়ি জেলার কয়েকটি গ্রাম গোয়ালন্দ, ইলিশমারীর চর, পাংশার গ্রাম। সে সময় এ অঞ্চলের দুর্ভিক্ষতাড়িত মানুষ বাদামূল্লুকে (দক্ষিণে বরিশাল অঞ্চল) ধান কাটতে যেত সেসব কথা তার নদীবক্ষে উপন্যাসে এসেছে। নদীবক্ষে মোট তিরিশটি পরিচ্ছেদে সমাপ্ত উপন্যাস। গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজ পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসের মূল চরিত্র রচনা করেছে লালু ও মতির সম্পর্ক। কৃষক লালুর সাথে তার চাচাতো বোন জমির শেখের কন্যা মতির আশৈশব সম্পর্ক। বয়সের সাথে সম্পর্ক প্রেমে রুপ নেয় এবং মিলন সঙ্কেতও পাওয়া যায়। এসব অবস্থায় কৃষিজীবী লালু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফসল ও হালের গুরু হারায়। বাদায় শোরগঞ্জে ধান কাটতে যায়। ফিরে এসে দেখে ইলিশমারীর চরের অবস্থানরত ফটিকের সাথে মতির বিয়ে হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে অসুখে ফটিকের মৃত্যু হলে অকালে বিধবা মতিকে পিতার সংসারে ফিরে আসতে হয়। এবার অত্যাধিক পরিশ্রমে লালু অসুস্থ হলে মতি তাকে সেবা শুশ্রুষা করে। লালুর মা অসুখে ভুগে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মরণকালে মা উভয়ের মিলন কামনা করে যান। এরপর মতি তার মামার বাড়িতে গেলে ফিরিয়ে আনার ভার পড়ে লালুর উপর। নৌকায় ফিরতে ফিরতে এক রোমান্টিক অবস্থায় উভয়ের মিলন ঘন্টা বেজে ওঠে। এই হল নদীবক্ষের কাহিনী। কৃষিভিত্তিক সমাজের পরিবারের সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে সহজ সরল বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে নওয়া হয়েছে এ কাহিনী।
|